পবিত্র রমজান মাস এসে গেছে আবারো। দীর্ঘ একটি বছর পর সকল মুসলমান ফিরে পেয়েছে পবিত্র মাস রমজানুল মোবারক। এই মাস উপলক্ষে সকল মুসলমান 30 টি ফরজ রোজা রেখে থাকে। যার জন্য সবাইকে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে সঠিকভাবে জানার প্রয়োজন পড়ে। যার মধ্যে একটি হলো রোজা রাখার নিয়ত। বাংলাদেশের অনেকেই আছে যারা জানেনা রোজা রাখার নিয়ত কিভাবে করতে হয়। তাদের জন্য আজকের এই পোস্ট এ বিস্তারিত ভাবে উল্লেখ করেছি রোজা রাখতে চাইলে কি নিয়ত করে রোজা রাখতে হবে। সকল মুসলমানের কাছে রমজান মাস অনেক মূল্যবান একটি মাস। এ মাসের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর কাছে মাগফেরাত কামনা করে। যার জন্য মানুষ ত্রিশটি রোজা অনেক আদবের সহিত পালন করে থাকে। তাই আজকের পোস্টে আলোচনা করবো রোজা রাখার নিয়ত ও কি কারণে রোজা ভঙ্গ হয়।
Contents
রোজা কি
রোজা মানে বিরত থাকা, শুধুমাত্র না খেয়ে বিরত থাকা নয়, সকল ধরনের পাপ কাজ থেকে দূরে থাকার নামই রোজা। তাই এই রমজান মাসে কাউকে গালি দেয়া, মিথ্যা কথা বলা, কারো হক মেরে খাওয়া এই সকল কাজ পরিত্যাগ করি। আর বেশি বেশি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি নিজেদের অতীত পাপের জন্য।
রোজা রাখার নিয়ত
আমরা অনেকেই আছি যারা রোজা রাখার নিয়ত পড়ে থাকি। যার জন্য আমরা উল্লেখ করেছি রোজা রাখার নিয়ত বাংলা ও আরবি। কারণ সাধারণত ইসলামের সকল বিষয় আরবি ভাষায় হয়ে থাকে। কিন্তু অনেকেই আছে যারা কুরআন পড়তে পারে না তাদের জন্য বাংলা নিয়ত উল্লেখ করা হয়েছে। নিচে থেকে রোজা রাখার বাংলা ও আরবি নিয়ত দেখে নিন।
রোজা রাখার নিয়ত বাংলায়
নিয়ত মানেই মনে মনে সংকল্প করা। অর্থাৎ আমি মনে মনে বললাম আমি কালকে রোজা রাখার জন্য সেহরি খাচ্ছি। এই জিনিসটাই হচ্ছে নিয়ত, তারপরও অনেকেই আছে যারা বিভিন্ন জায়গা থেকে একটু বড় আকারে নিয়ত করে থাকে। কিন্তু অবশ্যই খেয়াল রাখবেন আপনি যে আরবি নিয়ত টি পড়ছেন সে নিয়ত এর অর্থ কি। নিচে রমজান মাস উপলক্ষে রোজা রাখার বাংলা নিয়ত উল্লেখ করা হলো:
বাংলায় উচ্চারণ: নাওয়াইতু আন আছুমা গদাম মিন শাহরি রমাদ্বানাল মুবারকি ফারদ্বল্লাকা ইয়া আল্লাহু ফাতাক্বব্বাল মিন্নী ইন্নাকা আংতাস সামীউল আলীম।
রোজা রাখার বাংলা নিয়ত অর্থ: আয় আল্লাহ পাক! আপনার সন্তুষ্টির জন্য আগামীকালের রমাদ্বান শরীফ-এর ফরয রোযা রাখার নিয়ত করছি। আমার তরফ থেকে আপনি তা কবুল করুন। নিশ্চয়ই আপনি সর্বশ্রোতা , সর্বজ্ঞাত।
মাসআলা: কেউ যদি ছুবহি ছাদিক্বের পূর্বে নিয়ত করতে ভুলে যায় তাহলে তাকে দ্বিপ্রহরের পূর্বে নিয়ত করতে হবে। তখন এভাবে নিয়ত করবে:
বাংলায় উচ্চারণ: নাওয়াইতু আন আছুমাল ইয়াওমা মিন শাহরি রমাদ্বানাল মুবারকি ফারদ্বাল্লাকা ইয়া আল্লাহু ফা তাক্বাব্বাল মিন্নী ইন্নাকা আংতাস সামীউল আলীম।
রোজা রাখার আরবি নিয়ত
আমরা যেকোনোভাবেই নিয়োগ করতে পারি হোক সেটা বাংলা বা আরবি। তারপরও অনেকেই আছেন যারা আরবি পড়তে পারেন তাদের জন্য রোযা রাখার আরবি নিয়ত উল্লেখ করেছে আমরা। নিচে থাকে দেখুন রমজান মাসের রোজা রাখার আরবি নিয়ত। এবং অবশ্যই সেহরি খাওয়ার পর এই নিয়ত পড়বেন।
রোজা রাখার আরবি নিয়ত নিচে প্রদান করা হলোঃ
نَوَيْتُ اَنْ اُصُوْمَ غَدًا مِّنْ شَهْرِ رَمْضَانَ الْمُبَارَكِ فَرْضَا لَكَ يَا اللهُ فَتَقَبَّل مِنِّى اِنَّكَ اَنْتَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْم
রোজা ভঙ্গের কারণ
অনেকেই আছি যারা রোজা ভঙ্গের কারণ সম্পর্কে অবগত নই। অনেক তুচ্ছ বিষয় ঘটে গেলে আমরা মনে করি আমাদের রোজা ভেঙে গেছে। তা আপনাদের জন্য উল্লেখ করেছি কি কি কারণে রোজা ভেঙে যায়। তাই নিচে থেকে দেখুন কি কি করলে রোজা ভঙ্গ হয়।
- ইচ্ছাকৃত পানাহার করলে।
- স্ত্রী সহবাস করলে।
- কুলি করার সময় হলকের নিচে পানি চলে গেলে (অবশ্য রোজার কথা স্মরণ না থাকলে রোজা ভাঙ্গবে না)।
- ইচ্ছকৃত মুখভরে বমি করলে।
- নস্য গ্রহণ করা, নাকে বা কানে ওষধ বা তৈল প্রবেশ করালে।
- জবরদস্তি করে কেহ রোজা ভাঙ্গালে।
- ইনজেকশান বা স্যালাইরনর মাধ্যমে দেমাগে ওষধ পৌছালে।
- কংকর পাথর বা ফলের বিচি গিলে ফেললে।
- সূর্যাস্ত হয়েছে মনে করে ইফতার করার পর দেখা গেল সুর্যাস্ত হয়নি।
- পুরা রমজান মাস রোজার নিয়ত না করলে।
- দাঁত হতে ছোলা পরিমান খাদ্য-দ্রব্য গিলে ফেললে।
- ধূমপান করা, ইচ্ছাকৃত লোবান বা আগরবাতি জ্বালায়ে ধোয়া গ্রহন করলে।
- মুখ ভর্তি বমি গিলে ফেললে।
- রাত্রি আছে মনে করে সোবহে সাদিকের পর পানাহার করলে।
- মুখে পান রেখে ঘুমিয়ে পড়ে সুবহে সাদিকের পর নিদ্রা হতে জাগরিত হওয়া এ অবস্থায় শুধু কাজা ওয়াজিব হবে।
যেসব করলে রোজা ভঙ্গ হয় না
এখানে উল্লেখ করা হয়েছে কি কি করলে রোজা ভঙ্গ হয় না। আপনারা অনেকেই আছেন যারা জানতে চান কি কি করলে রোজা ভঙ্গ হয় না। তাদের জন্য সেই সকল কারণ দিয়ে একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। নিচে থেকে দেখুন কোন কাজগুলো করলে রোজা ভঙ্গ হয় না।
- ভুলক্রমে পানাহার করলে রোজা ভাঙে না।
- অনিচ্ছাবশত গলার মধ্যে ধোঁয়া, ধুলাবালি, মশা, মাছি চলে গেলে রোজা ভঙ্গ হয় না।
- স্বপ্নদোষ হলে রোজা ভাঙে না।
- তেল, সুরমা, শিঙা লাগালে হলকে তার স্বাদ পেলে রোজা ভঙ্গ হয় না।
- কাঠি দিয়ে কান খোঁচানোর ফলে কোনও ময়লা বের হলে তারপর ময়লাযুক্ত কাঠি বারবার কানে প্রবেশ করালে রোজা ভঙ্গ হয় না।
- যেকোনো সময় মিসওয়াক করলে রোজা ভাঙে না। সেটি কাঁচা হোক কিংবা শুষ্ক।
- দাঁত থেকে অল্প র*ক্ত বের হয়ে যদি গলার ভেতর চলে যায়, তাহলে রোজা ভাঙবে না। যদি র*ক্তের চেয়ে থুতুর পরিমাণ বেশি হয়, তাহলে রোজা ভেঙে যাবে।
- চানা বুটের চেয়ে ছোট বস্তু দাঁরে ফাঁকে আটকে গেলে এবং তা গলার ভেতর চলে গেলে কিংবা খেয়ে ফেললে রোজা ভাঙে না।
- শরীর, মাথা, দাড়ি, গোঁফে তেল লাগালে রোজা ভাঙে না।
- ফুল বা মৃগনাভির ঘ্রাণ নিলে রোজা ভাঙে না।
- ইচ্ছাকৃতভাবে নাকের শ্লেষ্মা মুখের ভেতর নিয়ে নিলে রোজা ভাঙে না।
- মুখের থুতু গিলে ফেললে রোজা ভাঙে না।
- তিল পরিমাণ কোনও জিনিস বাইরে থেকে মুখে নিয়ে অস্তিত্বহীন করে দেয়া ও গলায় তার কোনও স্বাদ অনুভূত না হলে রোজা ভাঙে না।
- কপালের ঘাম কিংবা চোখের দু-এক ফোঁটা অশ্রু কণ্ঠনালিতে পৌঁছে গেলে রোজা ভাঙে না; কিন্তু যদি পরিমাণে বেশি হয় যে তার প্রভাব গলায় অনুভব হয়। তাহলে রোজা ভেঙে যাবে।
- রোজা অবস্থায় সাধারণ ইনজেকশন বা টিকা লাগানো বৈধ। তবে এমন ইনজেকশন বা টিকা লাগানো মাকরুহ, যেগুলো দ্বারা রোজার কষ্ট বা দুর্বলতা দূরীভূত হয়।
- ইনজেকশনের মাধ্যমে র*ক্ত বের করলে রোজা নষ্ট হবে না। আর দুর্বলতার আশঙ্কা না থাকলে মাকরুহও হবে না।
- সাপ, বিচ্ছু ইত্যাদি দংশন করলে রোজা ভাঙে না।
- পান খাওয়ার পর ভালোভাবে কুলি করা সত্ত্বেও যদি থুতুতে লাল আভা থেকে যায়, তাহলে রোজা মাকরুহ হবে না।
- ভেজা কাপড় শরীরে দেয়া অথবা ঠান্ডার জন্য কুলি করা, নাকে পানি দেয়া অথবা গোসল করা মাকরুহ নয়।
- স্বপ্নে কিংবা সহবাসে যদি গোসল ফরজ হয়ে থাকে এবং সুবেহ সাদিকের আগে গোসল না করে রোজার নিয়ত করে, তাহলে তার রোজার মধ্যে অসুবিধা হবে না।
- গরমের দরুন দীর্ঘক্ষণ পানিতে অবস্থান করা মাকরুহ নয়।
- গলা খাঁকারি দিয়ে গলদেশ থেকে মুখে কাশি বের করা, তারপর আবার গিলে ফেলা মাকরুহ নয়।
- রোজা অবস্থায় মাথা বা চোখে ওষুধ দেয়া মাকরুহ নয়।
- হোমিওপ্যাথিক ওষুধের ঘ্রাণ নেয়া মাকরুহ নয়।
- রোজা অবস্থায় পাইপ দ্বারা মুখে হাওয়া নিলে রোজা মাকরুহ হয় না।
- রোজা অবস্থায় নাকের মধ্যে ওষুধ ব্যবহার করার দ্বারা ব্রেনে না পৌঁছালে রোজা মাকরুহ হয় না।
- শরীরে কোনও ক্ষতস্থান থেকে পুঁজ বা র*ক্ত প্রবাহিত হলে বা র*ক্ত বের করলে রোজা নষ্ট হয় না। তবে রোজাদার থেকে বের করা মাকরুহ।
- ডাক্তার যদি চিকিৎসার শুকনো কোনও যন্ত্র পেটে প্রবেশ করায়, অতঃপর তা বের করে ফেলে, তাহলে রোজা নষ্ট হবে না।
- পানিতে ডুব দেয়ার পর কানের ভেতর পানি চলে গেলে অথবা ইচ্ছাকৃত-ভাবে পানি দিলে রোজা মাকরুহ হয় না।
- জৈবিক উত্তেজনার কারণে শুধু দৃষ্টিপাতের কারণে যদি বীর্যপাত হয়, তাহলে রোজা নষ্ট হবে না।
ইফতার করার সুন্নত আমল
- খুরমা বা খেজুর দ্বারা ইফতার শুরু করা সুন্নত। আমাদের নবীজি খুরমা বা খেজুর দ্বারা ইফতার করতেন।
- ওয়াক্ত হওয়া অর্থাৎ আযান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করা সুন্নত। হাদীছে কুদসী শরীফ-এ রয়েছে, আল্লাহ পাক বলেছেন: “আমার বান্দাদের মধ্যে আমার নিকট অধিকতর প্রিয় ওই ব্যক্তিরাই যারা তাড়াতাড়ি ইফতার করে অর্থাৎ সময় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করে।” কিন্তু সময় হয়নি এমন অবস্থায় দ্রুত পানাহার করলে ক্বাযা-কাফফারা উভয়ই ওয়াজিব হয়ে যাবে। তাই সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
- ইফতার করার পূর্বে তিনবার দুরূদ শরীফ পাঠ করতে হবে।
- কোন রোযাদারকে ইফতার করানো। এটি একটি অত্যধিক ফযীলতপূর্ণ কাজ।
রোজা মাকরুহ হওয়ার কারণ
- অনাবশ্যক কোনো জিনিস চিবানো বা চাখা।
- কোনো দ্রব্য মুখে দিয়ে রাখা।
- গড়গড় করা বা নাকের ভেতর পানি টেনে নেয়া কিন্তু পানি যদি নাক দিয়ে গলায় পৌঁছে যায়, তাহলে রোজা ভেঙে যাবে।
- ইচ্ছাকৃত মুখে থুথু জমা করে গলাধঃকরণ করা।
- গীবত, গালা-গালি ও ঝগড়া-ফাসাদ করা। কেউ গায়ে পড়ে ঝগড়া-ফাসাদ করতে এলে বলবে, আমি রোজাদার তোমাকে প্রত্যুত্থর দিতে অক্ষম।
- সারাদিন নাপাক অবস্থায় থাকা। এটি অত্যন্ত গুনাহের কাজ।
- অস্থিরতা ও কাতরতা প্রকাশ করা।
- কয়লা চিবিয়ে অথবা পাউডার, পেস্ট ও মাজন ইত্যাদি দ্বারা দাঁত পরিষ্কার করা।
আমরা চেষ্টা করেছি আজকের পোস্ট এর সাহায্যে সবাইকে জানাতে কিভাবে রোজা রাখার নিয়ত করতে হয়। আশা করি এই পোষ্টের মাধ্যমে আপনারা জানতে পেরেছেন রোজা রাখার নিয়ত বাংলা ও আরবি সম্পর্কে। তাই রমজান মাস উপলক্ষে সবাইকে দোয়া টি পাঠিয়ে দিন।